মাদক পাচারের প্রধান রুট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক!

0
1611

বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের সমস্যাগুলোর অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে ‘মাদক’। বর্তমান সমাজে রন্ধে রন্ধে বিষধর সাপের মতো জড়িয়ে পড়েছে জীবনবিনাশী নীল নেশা মাদকদ্রব্য। এ এক তীব্র নেশায় ৩ হাজার তরুণ, তরুণীসহ যুবসমাজ এ নেশায় আসক্ত। দাবানলের মত তা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন শহরে, শহরতলীতে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, পাড়া-মহল্লায়। দেশের অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’ খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এখন সারাদেশে মাদক পাচারের প্রধান রুট হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মাদক বিক্রেতা, পাচারকারী ও মাদকসেবীরা সারাদেশে মাদকের বিষ ছড়িয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আর এ জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক রুটের বদৌলতে তারা দিবা-রাত্রি বিভিন্ন কৌশলে সরাদেশে মাদকের জাল ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়াও এই রুটে মিরসরাই, ফেনী ও কুমিল্লা অঞ্চলের সঙ্গে ভারতীয় সীমান্ত এলাকা হওয়ায় অতি সহজে ভারত থেকে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য, ফেনসিডিল, মদ, গাঁজা সীমান্ত পার করে গাড়িযোগে পাচারকারীদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাচার হচ্ছে। চলতি বছর এই রুটে মাদক পাচারের সময় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটলিয়ন (র‌্যাব) সদস্যদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে এক মাদক পাচারকারী ঘটনাস্থলে নিহত হওয়ার নজিরও রয়ছে। ভারত সীমান্ত থেকে মিরসরাইয়ের করেরহাট ইউনিয়নের লিচুতলা, বদ্ধ ভবানী, কুচিয়া খোন্দা, হেঁয়াকো বাজারের আন্দার মানিক এলাকা দিয়ে প্রায় সময় ভারতীয় ফেসসিডিল ও মদ রাতের আঁধারে অনায়াসে প্রবেশ করছে। এক শ্রেণির স্থানীয় অসাধু প্রভাবশালী মাদক সিন্ডিকেট তা সীমান্ত এলাকা দিয়ে পাচার করে দেশের বিভিন্ন বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এসব মাদক পাচারের জন্য আলাদা লোক নিয়োগ করা থাকে। তাদের কাজ শুধু রাতের আঁধারে সীমান্ত পার করে মাদক ওপার থেকে এপারে এনে রাখা। এদেরকে দিনের বেলায় কেউ দেখে না। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় এদের তৎপরতা দেখা যায়। এদিকে ফেনী জেলার ছাগল নাইয়া উপজেলা দিয়ে ভারতীয় সীমান্ত খুব কাছাকাছি হওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম পুরাতন মহাসড়কের শুভপুর হয়ে গোপাল ইউনিয়নের মুহুরীগঞ্জ রেল লাইন হয়ে এবং শুভপুর মুহুরী নদী পার হয়ে পূবালী-ফাজিলপুর হয়ে ফেনী সদরে ভারতীয় মাদক ও অবৈধ মালামাল প্রবেশ করছে। এ ছাড়াও গোপাল ইউনিয়নের স্থানীয় সড়ক ক্যাপ্টেন বদিউল আলম সড়ক হয়েও ফেনী সদরে প্রতিনিয়ত এসব মাদক প্রবেশ করছে। এদিকে জোরারঞ্জ থেকে মুহুরী প্রজেক্ট হয়ে ফেনী জেলার সোনাগাজী দিয়ে আঞ্চলিক এলাকাগুলো মাদক প্রবেশ করে। ভারতীয় সীমান্ত এলাকা ফেনী, ছাগলনাইয়া এবং মিরসরাই অঞ্চল দিয়ে মাদক চট্টগ্রামে প্রবেশ করছে। আর এই পথে চট্টগ্রামে প্রবেশদ্বারে রয়েছে জোরারগঞ্জ থানা।

এই থানা সূত্রে জানা যায়, গত বছর জোরারগঞ্জ থানায় মোট মাদক মামলা হয়েছে ২৬৮টি। মাদক সংক্রান্ত মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ৩০৯ জন। এ সময় থানা পুলিশ জব্দ করেছে চারটি প্রাইভেটকার, ১টি কাভার্ডভ্যান ও ১টি মিনি পিককাপ। মাকদ্রব্যের মধ্যে-ইয়াবা সাড়ে ৩৬ হাজার পিস, প্রায় ৩ হাজার বোতল ফেনসিডিল, গাঁজা ২৮ কেজি, চোলাইমদ ১ হাজার ২ শত লিটার।

বিশ্লষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, এক থানায় যদি মাদকের এই অবস্থা হয় তাহলে দেশের অন্যান্য থানার কী অবস্থা? বছরে কতশত হাজার কোটি টাকা মাদকের বাণিজ্য চলে এদেশে।

এদিকে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার বড় বড় চালান পাচারকারীদের মাধ্যমে স্থল ও জলপথে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম হয়ে এবং নদীপথে চট্টগ্রাম হয়ে বাড়ককুণ্ড এবং সীতাকুণ্ডে আনা হয়। পরে এই রুট ব্যবহার করে ইয়াবা সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীরা।

সূত্র জানায়, সারা দেশে ইয়াবা পাচারে মাদকব্যবসায়ী এবং পাচারকারীরা ব্যবহার করছে নিত্য-নতুন, নামি-দামি প্রাইভেটকার ও বিলাসবহুল গাড়ি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি ও র‌্যাব কর্তৃক আটককৃত, মাদক পাচারের সময় জব্দ করা গাড়ি ও চেকপোস্টে গাড়ি থেকে মাদক উদ্ধারের নিমিত্তে এসব নামি দামি গাড়ি ব্যবহারের বিষয়টি ওঠে আসে। প্রাপ্ত তথ্যে আরো জানা যায়, এক সময় ইয়াবা পাচারকারীরা গাড়িতে করে, ব্যাগে করে, গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশের সঙ্গে বেঁধে, শরীরে বেঁধে, বাদ্য যন্ত্রের ভেতরে, সর্বশেষ মলদ্বারে এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পেটের ভেতরে এই মাদক পাচার করে আসছিল। এ ছাড়া এই পাচারে যাদের ব্যবহার করত এদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী। পুরুষ যারা পাচারকারী হিসেবে মাদক বহন করত, তাদের বেশ-ভূষা ছিল এক প্রকার শ্রমিকের মত। এসকল কৌশল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জেনে গেলে পাচারকারীরা ভোল পাল্টিয়ে পাচারকাজে নামি-দামি প্রাইভেটকার যোগে ভদ্রলোক সেজে মাদক পাচার করছিল। সম্প্রতি চলতি বছরের বিভিন্ন সময়ে এসব নামি-দামি প্রাইভেটকারসহ কতিপয় মাদক পাচারকারী আটক ও মাদক দ্রব্য উদ্ধারের পর বিষয়টি সকলের দৃষ্টি গোচর হয়।

ইয়াবা পাচারকারীদের সর্বশেষ পরিবর্তনের অন্যতম মাধ্যম নামি-দামি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রাইভেটকার, বিলাসবহুল গাড়ি। তারা দামি পোশাক পরিধান করে ভদ্রলোক সেজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারী এড়ানোর চেষ্টা করছে বলে সূত্রে জানা যায়। কিন্তু এতেও তাদের শেষ রক্ষা হচ্ছে না। মাদক পাচার কারীরা যত কৌশল অবলম্বন করুক না কেন, কয়েকদিন পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী ঠিকই তাদের চাল ধরে ফেলছেন। তবে এখনো অধরা রয়ে যাচ্ছে এই রুটে চলা বিলাসবহুল গাড়িতে ভদ্রলোকবেশী মাদক পাচারকারীরা। পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অনেক সময় এসব গাড়ি থামালেও অনেকে এটাকে হয়রানী মনে করছেন। একটা গাড়ি যখন কক্সবাজার থেকে ছেড়ে ঢাকার উদ্দ্যেশে রওনা হয়, তখন ঢাকা পর্যন্ত কয়েকটি চেকপোস্টে যখন গাড়িগুলো থামানো হবে এতে করে একটু সময় লাগবে। আর এতে যাত্রীসাধারণ খুব বিরক্ত বোধ করেন। পুলিশ আরো জানায়, তারা বিভিন্ন চেকপোস্টে লোকাল গাড়িগুলো থামিয়ে চেক করে কিছু মাদক দ্রব্য উদ্ধার করে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় নিয়ে আসে।

তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে উদ্ধার হওয়া মাদক দ্রব্য পাচারের তুলনায় কম। প্রতিদিন এইরুটে গড়ে কয়েক কোটি টাকার মাকদ্রব্য পাচার হয়। চলতি বছর মিয়ানমারের নাগরিকরা অবাধে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় ইয়াবাব্যবসায়ীরা মিয়ানমারে থাকা তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রচুর পরিমান ইয়াবা বাংলাদেশে প্রবেশ করিয়েছে। বর্তমানে ওই ইয়াবাগুলো সময়-সুযোগ বুঝে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাচার করছে। ইয়বা পাচারের সময় সম্প্রতি কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময় ইয়াবাসহ মিয়ানমারের নাগরিকদের গ্রেফতার করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

মিরসরাই সর্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মশিয়ার রহমান বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান সব সময় জিরো টলারেন্স। বিলাসবহুল গাড়ির বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের কাছে কোনো বিলাসবহুল গাড়ির নির্দিষ্ট তথ্য থাকলে (গোয়েন্দা শাখা এবং সোর্স) আমরা সেটাকে থামিয়ে তল্লাশি করে মাদক থকালে উদ্ধোর এবং পাচারকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসছি। এ ছাড়াও এই রুটে নিয়মিত চেকপোস্ট বসিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন সময়ে এই রুটে মাদকের বড় বড় চালান আটক করায় এবং মাদক ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনায় মাদক পাচার, সেবন এবং বিকি-কিনি অনেকটা কমে গেছে। মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান আর দৃঢ় হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

মানবকণ্ঠ

মন্তব্য করুন