মেডিকেল কলেজগুলো নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের স্বেচ্ছাচারিতা, রমরমা বাণিজ্য

0
741

 

দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ বর্তমানে চালু আছে ৬৮টি এবং ডেন্টাল ২৫টি। এই ৯৩টি কলেজের কোনোটিই পুরোপুরি নিয়মনীতি মেনে চলছে না। কোনোটির নীতিমালা অনুযায়ী নেই প্রয়োজনীয় জমি, কোনোটির শিক্ষক নেই, রোগী নেই, অবকাঠামো নেই প্রভৃতি নানাভাবে নীতিমালা লঙ্ঘনের মধ্য দিয়েই চলছে বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলো। আর সেই সুযোগটিই নিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজরা। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিরা নীতিমালা অনুসরণের কথা বলে চাপ দিয়ে, ব্ল্যাকমেইল করে দফায় দফায় শুধু ঘুষই আদায় করছে। বাস্তবে এগুলোকে নিয়মনীতি অনুযায়ী চালানোর ব্যাপারে তারা কখনো আন্তরিকভাবে কাজ করেনি। তাই মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষরাও সেই সুযোগটিই নিচ্ছে।

দেখা যাচ্ছে, এসব মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠাই করা হয়েছে নীতিমালার শর্ত লঙ্ঘন করে। প্রতিষ্ঠার পর অনেক বছর পার হয়ে গেলেও এখনো নীতিমালার শর্তগুলো পূরণের যথাযথ উদ্যোগ নেই তাদের। এর ফলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে মানসম্পন্ন ডাক্তার তৈরি হওয়ার পরিবর্তে এমবিবিএস সার্টিফিকেটধারী হাতুড়ে ডাক্তার তৈরি হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর পরিদর্শন, নবায়ন, ছাত্রভর্তি কোটা প্রভৃতির ব্যাপারে স্বেচ্ছাচারি আচরণ করছে। মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতর নিজেরাই এ ব্যাপারে নিয়মনীতি মানছে না। একই অপরাধে কোনোটির সাজা হচ্ছে, আবার কোনোটি ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। পরিদর্শন রিপোর্টেও সামঞ্জস্যতা নেই। রিপোর্টও ভালো থেকে খারাপ, আবার খারাপ থেকে ভালো হয়ে যাচ্ছে। নীতিমালার শর্ত পূরণের ব্যাপারে যেসব ঘাটতি রয়েছে তা অনেক ক্ষেত্রেই এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবার কোনো কোনোটির বিরুদ্ধে আগাম কোনও সতর্কতা ছাড়াই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ গত বছর এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ বেশ ক’টি প্রতিবেদন ছেপেছিল। তারপরও পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি। বরং গতবারের মতো একই দুর্নীতিবাজচক্র ঘুষ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে দেদারছে।

সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না
ক্রাইটেরিয়া বা নীতিমালা কে কতটুকু মানছে এ ব্যাপারে সমন্বিত ও নিরপেক্ষ কোনো মূল্যায়ন নেই। নিয়ম অনুযায়ী কোন্ মেডিকেল কলেজের কী ঘাটতি রয়েছে তা বোঝার জন্য সবগুলো মেডিকেল কলেজের সমন্বিত রিপোর্ট তৈরি করা দরকার। গত বছর এ নীতি অনুসরণের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছিল। ছক তৈরি করার কথা বলা হয়েছিল। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ কোনটির কী ঘাটতি রয়েছে তা ছকের মাধ্যমে তুলে ধরতে বলা হয়েছিলো। সবগুলোর ব্যাপারে একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। কয়েকটি মেডিকেল কলেজ পরিদর্শন করে সেগুলোর ব্যাপারে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাকিগুলো কীভাবে চলছে তা খতিয়ে দেখা হয়নি। চলতি বছরও মেডিকেল কলেজ পরিদর্শন ও নবায়নে একইভাবে স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন কমিটির একজন সদস্য শীর্ষ কাগজের এ প্রতিবেদকের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা মাত্র ৬/৭টি মেডিকেল কলেজের তথ্য নিয়ে আলোচনা করছি, সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। বাকিগুলোর কী অবস্থা জানি না। বাকিগুলোর অবস্থা এরচেয়েও খারাপ হতে পারে। যদি তাই হয়, তাহলে তো আমরা বৈষম্যমূলক আচরণ করছি। যে কেউ এক্ষেত্রে আমাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে পারে। তিনি এমন একপেশে কর্মকা-ে অসন্তোষ প্রকাশ করে একথা বলেন।

উল্লেখ্য, চলতি বছর ৫টি মেডিকেল কলেজ ও ১টি ডেন্টাল কলেজের ছাত্রভর্তি স্থগিত করা হয়েছে। গত ১৭ আগস্ট স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রণালয়ের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গত বছরও একইভাবে অন্য ৫টি মেডিকেল কলেজের ছাত্রভর্তি স্থগিত করা হয়েছিল। কিন্তু জানা গেছে, অন্যান্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর মধ্যে বেশক’টির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এগুলোর চেয়েও খারাপ। কোনো কোনোটির প্রয়োজনীয় বেড অথবা বেড অকুপেন্সি অত্যন্ত নাজুক। অথচ সেগুলোর ব্যাপারে কোনও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে সেগুলোর সমস্যা ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। গত বছর দেখা গেছে, ডেল্টা মেডিকেল কলেজসহ কয়েকটি মেডিকেল কলেজের ছাত্রভর্তির কোটা কমানোর সিদ্ধান্তও রাতারাতি পাল্টে গিয়েছিল মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে।
তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি
বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় বিদেশি কোটার নামে ঘুষ লেনদেনের রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। গত বছর বা তার আগের বছর দেখা গেছে, দেশি শিক্ষার্থীদের মেধা তালিকার সামনের দিকের ছাত্ররা ভর্তি হতে পারেনি। এই কোটার অন্তরালে পেছনের অমেধাবী ছাত্রদের ভর্তির সুযোগ দেয়া হয় মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে। বিদেশি কোটার নামে দেশি ছাত্র ভর্তিতে ঘুষ লেনদেন হয়েছে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় মোট প্রায় ২০০ কোটি টাকা। পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হলে এক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) এর নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) ডা. আবদুর রশিদ ছিলেন কমিটির সদস্য সচিব। গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি ওই কমিটি গঠন এবং কমিটিকে ৭ দিনের সময় দেয়া হয়েছিল। অথচ আজ পর্যন্ত সেই তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। জানা গেছে, এই রিপোর্ট তৈরির নামে ডা. রশিদ বড় অংকের চাঁদাবাজি করেছেন। আর সেই কারণেই তিনি কমিটির কর্মকা- থামিয়ে দিয়েছেন।
দুর্নীতিবাজ রশিদ আরও ক্ষমতাবান
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত ৮ সদস্যবিশিষ্ট পরিদর্শন কমিটির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) ডা. আবদুর রশিদ। কিন্তু তিনি একজন চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত। গত বছর সরকারি মেডিকেল কলেজে বিদেশি ছাত্র ভর্তিতে দুর্নীতি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েন আবদুর রশিদ। মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির তদন্তে তার দুর্নীতি প্রমাণিতও হয়। তারপরও মন্ত্রীর ছত্রছায়ায় থেকে তিনি বেঁচে যান। এখন ডা. রশিদ আরো ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ক্ষমতাবান হওয়ার সুবাদে ডা. রশিদ বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো থেকে ব্যাপকহারে ঘুষ বাণিজ্য করে যাচ্ছেন। ৫টি মেডিকেল কলেজে ছাত্রভর্তি স্থগিত হওয়ার পর এগুলোকে নজির হিসেবে দেখিয়ে অন্য মেডিকেল কলেজগুলোর কাছ থেকে মোটা অংকের ঘুষ আদায় করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
(সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজে ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর প্রকাশিত)

মন্তব্য করুন